পাহাড়ি সংস্কৃতির অন্যতম পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘বাঁশে রান্না’ এখন কেবল পাহাড়িদের ঘরেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাঁশের চুঙ্গায় রান্না করা এই বিশেষ খাবারগুলো যেমন স্বাদে অনন্য, তেমনি গন্ধ ও পরিবেশনায়ও আলাদা।
বাঁশে রান্না: হাজার বছরের পুরোনো রীতির আধুনিক জনপ্রিয়তা
পাহাড়ি নৃগোষ্ঠী যেমন ত্রিপুরা, মারমা, চাকমাদের খাদ্যসংস্কৃতিতে বাঁশে রান্না করার প্রচলন হাজার বছর ধরে বিদ্যমান। তারা কেবল বাঁশের পাত্র ব্যবহার করেই নয়, কাঁচা বাঁশকেও প্রধান উপাদান হিসেবে তরকারিতে যুক্ত করে থাকেন।
গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরা জানান, “মানুষ যখন থেকে রান্না শিখেছে, তখন থেকেই বাঁশে রান্নার রীতি শুরু হয়েছে। মাটির হাঁড়ি আসার আগে বাঁশই ছিল প্রধান মাধ্যম।”
অন্য এক গবেষক মংসানু মারমা বলেন, “শুধু ঐতিহ্য নয়, বাঁশে রান্না করা খাবারে এক আলাদা স্বাদ ও ঘ্রাণ থাকে। বিশেষ করে মুলি বা ডুলু জাতের কাঁচা বাঁশেই সেরা ফল পাওয়া যায়।”
পর্যটকদের কাছে ‘ব্যাম্বু চিকেন’ সেরা আকর্ষণ
বাঁশে রান্না করা খাবারের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম হলো ব্যাম্বু চিকেন। মুরগির মাংস, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, ধনেপাতা ইত্যাদি মিশিয়ে বাঁশের চুঙ্গায় ভরে তা কলাপাতা দিয়ে ঢেকে আগুনে রান্না করা হয়। এতে এক অনন্য ফ্লেভার তৈরি হয়, যা আধুনিক পাত্রে সম্ভব নয়।
খাগড়াছড়ির জনপ্রিয় পাহাড়ি রেস্টুরেন্ট ‘সিসটেম’-এর উদ্যোক্তা মংসানু মারমা বলেন, “শুক্র-শনিবার যখন পর্যটকের ভিড় থাকে, তখন ব্যাম্বু চিকেনের অর্ডার সবচেয়ে বেশি আসে।”
ঢাকা থেকে সাজেক বেড়াতে আসা ব্যবসায়ী নুর হোসেন পল্লব জানান, “এমন স্বাদের খাবার আগে কখনো খাইনি। একেবারেই নতুন এক অভিজ্ঞতা।”
বাঁশে রান্নার অন্যান্য রেসিপি
বাঁশে শুধু চিকেনই নয়, রান্না হয় ছোট মাছ, ডিম, শাকসবজি, এমনকি ভাতও। মারমা সম্প্রদায়ের ‘গুদায়া’ ও ‘কেদামু’, ত্রিপুরাদের বাঁশে রান্না করা বিভিন্ন রেসিপি ইতোমধ্যেই স্থানীয় রেস্টুরেন্টগুলোতে যুক্ত হয়েছে।
জনপ্রিয় রেসিপি সমূহ:
- ব্যাম্বু চিকেন (Bamboo Chicken)
- বাঁশে ভাত
- গুদায়া (Bamboo Cooked Veg & Fish Mix)
- বাঁশে শাক-সবজি
- বাঁশে ডিম কারি
- কেদামু (বাঁশে তৈরি বিশেষ মারমা খাবার)
বাঁশে রান্নার পদ্ধতি
ব্যাসিক প্রস্তুতি:
- কাঁচা বাঁশের মোটা অংশ কেটে নিন (মুলি বা ডুলু জাতের হলে ভালো)
- ধুয়ে পরিষ্কার করুন
- মাংস বা অন্য উপকরণ মশলা দিয়ে মাখিয়ে বাঁশে ঢোকান
- কলাপাতা দিয়ে মুখ বন্ধ করুন
- কয়লার আগুনে ৩০ মিনিট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাঁধুন
গুরুত্বপূর্ণ টিপস:
- বাঁশ হতে হবে কাঁচা
- অতিরিক্ত মশলা ব্যবহার নিষেধ
- বাঁশের চুঙ্গা বেশি পুরানো হলে রান্নায় সমস্যা হতে পারে
শহরেও জনপ্রিয় হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই খাবার
শুধু পাহাড়েই নয়, এখন শহরের অনেক রেস্টুরেন্টেও পাওয়া যাচ্ছে বাঁশে রান্না করা খাবার। খাগড়াছড়ির ‘সিসটেম’, ‘খাংময়’, ‘জুমঘর’, ‘ইজর’, ‘টং’-সহ বিভিন্ন রেস্তোরাঁতে এই খাবার পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিত।